সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর শুরুর কথা !!
আবুল হোসাইন মাহমুদ
সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় কে হামদ, না‘ত ইসলামী গান রচনা করেছিলেন এবং তাতে সুরারোপ করে কে গেয়েছিলেন সে ইতিহাস আজো আমাদের অজানা। কারণ, ইসলাম ও মুসলিমদের এসব বিষয়ে এ অঞ্চলে গবেষণা হয়নি বললেই চলে। তবে সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ হতে ভক্তিমূলক সঙ্গীত সাধনার একটি সুরময় জগত বাংলা ভাষাভাষী জনপদে বিকাশ লাভ করেছে বলে অনেকে মনে করেন। এ সমস্ত সঙ্গীত মূলতঃ ইরানী আধ্যাত্মিক সঙ্গীতকলার প্রভাবে প্রভাবিত। একথা সত্য যে, মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্যে শুরুতে এবং শেষে হামদ না‘ত লিখার প্রচলন ছিল। পূঁথি যখন সুর করে পড়া হতো এই হামদ, না‘তগুলোকে সেই সুরেই গাওয়া হতো। মুর্শিদী, মারফতী, জারী এবং পালা গানেও হামদ, না‘ত ছিল । আলাউল, সৈয়দ মর্তুজা, খান গয়াস, ফাজিল নাসির মাহমুদ, মেছের শা, পঞ্জু শা, শেখ মদন বাউল, জোবেদ আলী, পাগলা কানাই, লালন শাহ্, হাসন রাজা, সীতালং শা, আরকুম শা, শাহনূর, দীনহীন, শেখ ভানু প্রমুখ সাধক কবিবৃন্দ ইসলামী আধ্যাতিক সঙ্গীতের উদ্ভব ও পরিণতির পর্যায়ের সুপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ। তাদের অনেক পরে মীর মোশাররফ হোসেনের বাংলা মৌলুদ শরীফ, মুনশী মেহেরুল্লাহর ভক্তিমূলক হামদ না‘ত আমরা দেখতে পাই।
যাদের গানের কথা বলা হলো তাদের গানে রয়েছে ভক্তির উচ্ছাস । সমাজ বা সমাজের বিশেষ বিষয়ের কোন আবেদন ছিলনা তাদের গানে। মূলতঃই এগুলো ছিল ভক্তিগীতি। ১৭৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর হতে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় পর্যন্ত যে সমস্ত ভক্তিমূলক হামদ না‘ত রচিত হয়, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তার আমূল পরিবর্তন ঘটান কবি নজরুল ইসলাম- তার হামদ না‘ত ও ইসলামী গানে। তখন থেকে ইসলামী গান আর হামদ না‘ত থাকলো না। নজরুল ইসলাম তার গানে নিয়ে আসলেন ইসলামী জাগরণী, ঘুম ভাঙানী গান। মুসলমানদেরকে জেগে উঠার আহবান জানিয়ে খালিদ/তারিক/মুসা হবার অনুপ্রেরণা ছিল তার গানে। ইসলামী গান তখন থেকেই সমাজের গান হলো। ভাষা, সুর উপস্থাপনা সব মিলিয়ে চির আধুনিক হয়ে উঠল ইসলামী গান । সেই সময়ের জনপ্রিয় শিল্পী আব্বাস উদ্দীন এসব গানকে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে গেয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। সেই পথ ধরেই এগিয়ে এলেন কবি গোলাম মোস্তফা, আজিজুর রহমান, ফররুখ আহমদ। তারাও লিখলেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইসলামী গান। তাদের সময়ে বা তাদের পরে আরো বেশ ক‘জন গীতিকার ইসলামী গান লিখেছেন। তাদের মধ্যে আবদুল লতিফ, ফজলে খোদা, সাঈদ সিদ্দিকী, সাবের আহমদ চৌধুরী অন্যতম। তারাও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইসলামী গান লিখেছেন। এসব গানের দু‘টি ধারা ছিল। প্রথম ধারাটি বাদ্যযন্ত্র সহ গাওয়া হয়ে থাকে। যা সাধারণতঃ রেডিও, টেলিভিশনে যা গীত হয়। সেই বাদ্যযন্ত্রসহ গানটিই যখন কোন সভা-সমিতিতে বা ওয়াজ মাহফিলে খালি গলায় অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গাওয়া শুরু হলো তখনই দ্বিতীয় ধারাটি চালু হয়। বাদ্যযন্ত্রবিহীন ধারাটির সৃষ্টি হলো মূলত তাকওয়ার কারণে। ইসলামে বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ- এ ধারণা থেকেই এ ধারার জন্ম। যা এদেশের ইসলাম প্রিয় মানুষ বহু আগে থেকেই করে আসছিল। অবশ্য এটি সীমাবদ্ধ বেশি ছিল গ্রামাঞ্চলে মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের মধ্যে। বিশেষ করে মাদরাসা কেন্দ্রিক ওয়াজ মাহফিলগুলোতে।
তারপর এদেশে দ্বীন প্রতিষ্ঠার দীপ্ত প্রত্যয়ে মানুষের জাগরণ শুরু হয়। ইসলামী জীবন বিধানের সামগ্রিকতা জনমনে পরিব্যাপ্ত হতে থাকে। তখন থেকে সাধারণ শিক্ষিত লোকদের মাঝে শুদ্ধ সাংস্কৃতিক জীবনাচারের বোধ জাগ্রত হয়। তাদের মধ্যে এ বোধ জাগ্রত হয় যে- আল্লাহ শুধু একজন স্রষ্টা মাত্র নন, সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) একজন সর্বমান্য রাসূল শুধু নন, একজন বিপ্লবী নেতা, জীবনের সর্বত্র অনুসরণীয় আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক, এবং সমরবিশারদ। অর্থাৎ শিক্ষিত মানুষের মনে এটা জাগ্রত হলো যে ইসলাম শুধুমাত্র ধর্ম নয় বরং একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। কুরআনে বর্ণিত মুসলমানরা বিশ্ব বিপ্লব সৃষ্টির জন্য প্রেরিত একটি ‘‘উত্তম জাতি’’ । এভাবে ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।
যুগে যুগে নবী রাসূলগণ যে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন, সে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পুরোমাত্রায় কাজ শুরু হলো এই জনপদে। অনেক চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। দেশ স্বাধীনের পর সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এলো চরম বাধা। সেই চরম বিরোধিতার মধ্যেও এ আন্দোলন থেমে যায়নি। বলতে গেলে ঐ সময়টাতে সমস্ত অসম্ভবের বিরুদ্ধে কাজ করে যেতে হয়েছিল। একদল নিরলস ও নিষ্ঠাবান কর্মীবাহিনী এ ভূখন্ডে রাত দিন খেটে সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে জিইয়ে রেখেছিলেন। অবশ্য তদানিন্তন সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে অনেক কর্মীকে। এজন্য খুব গোপনে (টেকনিক) বিভিন্ন স্থানে তারা প্রোগ্রাম করতো। এ সময়টাতে প্রোগ্রামগুলো হতো ঘরোয়াভাবে। মূলত এই সময়টা ছিল কর্মী তৈরীর সময়। তাই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম বেশী হতো। এসব প্রোগ্রাম নিতান্তই নিরস ছিল। এভাবেই প্রশিক্ষিত হতে থাকলো কর্মীরা এবং বাড়তে থাকলো তাদের পরিসর। একই সময়ে তাদের মধ্যে সুস্থ সংস্কৃতির ধারনাও জাগ্রত হতে থাকলো। এভাবে চলল কয়েক বছর।
১৯৭৩ সালে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের একটি প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল। ঐ প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রথম একটি উদ্যোগ নেন একজন কর্মী। তিনি ভাবলেন অনুষ্ঠান কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে শুরু হওয়ার পর আর বাকী অনুষ্ঠানটুকু একঘেয়েমী বলে মনে হয়। তিনি বৈচিত্র আনার জন্য অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে হামদ না‘ত গাওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনিই প্রথম ঐ অনুষ্ঠানে একটি হামদ গেয়ে শোনান। হামদটি ছিল কবি গোলাম মোস্তফার ‘হে খোদা দয়াময় রহমান রহীম।’ হামদটি গাওয়ার পর অনেকের কাছেই তা ভাল লাগে। তিনি হলেন ডাঃ মোহসীন। তার দেখাদেখি আরো কয়েকজনকে পাওয়া গেল যারা গান গাইতে পারেন। এরপর থেকে অনুষ্ঠান গুলোতে এভাবে দু‘একজন হামদ না‘ত গাইতেন।
১৯৭৪ সালের শেষের দিকে আবুল কাশেম মিন্টু খুলনায় বেড়াতে যান। সেখানে আনসার উদ্দীন হেলালের বাড়ীতে প্রোগ্রাম হয়েছিল। ঐ প্রোগ্রামে প্রথম ইসলামী সঙ্গীত গাওয়া হয়। গান গেয়েছিলেন মতিউর রহমান মল্লিক। তার রচিত ঐ গানটি ছিল ‘‘মুসলিম আমি সংগ্রামী আমি/আমি চির রণবীর/আল্লাহকে ছাড়া কাউকে মানিনা/ নারায়ে তাকবীর। অবশ্য ষাটের দশক থেকেই বিশেষ করে ৬৭/৬৮ সালের দিকে মতিউর রহমান মল্লিক মাদরাসার ছাত্রাবস্থায় এ ধরনের গান লিখে নিজেই মাদরাসার বিভিন্ন মাহফিলে গাইতেন বলে জানা যায়। তার আল বদর আল বদর গানের মাধ্যমেই গানের জগতে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। যাহোক ঐ অনুষ্ঠানে তার গানটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারণ, তখনও এ আন্দোলনের কোন অনুষ্ঠানেই এ ধরনের গান গাওয়া হতো না। যে সমস্ত গান গাওয়া হতো ঐগুলোর মধ্যে হামদ না‘তই ছিল প্রধান। বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা প্রমূখের হামদ না‘ত গাওয়া হতো।
‘মুসলিম আমি সংগ্রামী’ গানটির কথা এবং সুরে ছিল নতুনত্ব। প্রচলিত হামদ না‘ত থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের। মতিউর রহমান মল্লিকের এ গানটির নতুনত্ব দেখে আবুল কাশেম মিন্টু তাকে কাছে আনেন এবং অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময় তাকে নিয়ে একই রিক্সা ভ্যানে করে আসেন। পথে তার কাছ থেকে আরো অনেক গান শুনেছিলেন। যার সবগুলোই ছিল গায়কের স্বরচিত। সেখান থেকেই আবুল কাশেম মিন্টু তাকে ঢাকায় আনার পরিকল্পনা নেন। সম্ভবতঃ পরবর্তীতে দায়িত্বশীলদের সাথে এ ব্যাপারে আলাপও হয়েছিল।
চলবে….
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন