সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর শুরুর কথা!! (পর্ব-২) আবুল হোসাইন মাহমুদ
১৯৭৫ সালে দায়িত্বশীল আবু তাহেরের ইঙ্গিতে মতিউর রহমান মল্লিক ঢাকাতে আসেন। তখন ঢাকায় সংগঠনের শুরার প্রোগ্রামের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন তিনি। কিছুদিন তিনি ঢাকায় থাকেন। কিন্তু ঢাকায় তার ভাল লাগলোনা। তার এ ভাল না লাগার কথাটি জানান আবুল কাশেম মিন্টু, বাশারত হোসেন ও আনসার উদ্দীন হেলালকে। তখন তাকে ঢাকা থেকে চলে যেতে অনুমতি দেয়া হয়। ইতিমধ্যেই ঢাকাতে একটি সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা হয়ে যায়। পরে তাকে ঢাকাতেই থেকে যেতে হয়।
পরিকল্পনা হওয়ার পর কামরুজ্জামান মাসুম তাকে কাজ শুরু করতে বলেন। কাজ শুরু করতে বলার অর্থ গোষ্ঠী নামে কাজ করা নয়। শুধু শিল্পী বের করাই ছিল প্রথম কাজ। যাদের কণ্ঠ ভাল তাদের মধ্য থেকে শিল্পী সংগ্রহের অভিযান চললো। মূলত তখন সংগঠনের মধ্য থেকেই এ কাজ চলছিল। এ কাজে সহযোগিতা করলেন আবদুল্লাহ ও হেমায়েত হোসেন।
শিল্পী সংগ্রহ অভিযানে মুটামুটিভাবে সফল হলেন। বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান কণ্ঠের লোক পাওয়া গেল। এদের মধ্যে খন্দকার রাশিদুল হাসান তপন, হাসান আখতার, গিয়াসউদ্দীনকে প্রথম পাওয়া যায়। শিল্পী পাওয়া গেলে কি হবে। গান শেখানো হবে কোথায়? কোন অফিস নেই, কিছু নেই। তারপরও গান তো শিখতে হবে। তাই আগামসিহ লেনের একটি ঝুপড়িতে গানের প্রথম ক্লাশ হয়। উক্ত তিনজনই ঐ ক্লাসে ছিলেন। পরবর্তীতে দায়িত্বশীল আবদুল্লাহর সহযোগিতায় পাওয়া গেল সূত্রাপুরের আলী আহমদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল হালিম খানকে। পরে পাওয়া যায় শফিকুল্লাহকে। তিনি বেশ আগ্রহী ছিলেন। তাদেরকে নিয়ে তিন চারদিন ধরে গানের প্রশিক্ষণ হলো।
সংগঠনের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তাদের গান শেখার কাজ চললো। তাদের প্রথম প্রোগ্রাম করার ডাক পড়লো ঢাকার মোহাম্মদপুর সেন্ট্রাল কলেজে। এখানে সংগঠনের প্রশিক্ষণ শিবির চলছিল । ঐ শিবিরে আবদুল হালিম ‘‘তীর হারা ঐ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে’’ গানটি গেয়ে শোনান। ওখানে গানগুলো এককভাবে গাওয়া হয়। শিল্পী ছিলেন আবদুল হালিম, ডালিম ও আলী আহমদ । গানগুলো ছিল-
‘‘মুসলিম আমি সংগ্রামী আমি’’
‘‘এখানে কি কেউ নেই’’
‘‘চলো মুজাহিদ চলো’’
‘‘এলো কে কাবার ধারে’’
অনুষ্ঠানে বৈচিত্রের জন্য প্রচলিত কিছু নির্দোষ গান গাওয়া হয়। অনুষ্ঠানটির ধারা লিখেছিলেন মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব। ঐ অনুষ্ঠানটি বেনামে করা হয়। অর্থাৎ কোন গোষ্ঠীর নাম হয়নি তখনো।
যখন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শুরু হলো তখন সাংস্কৃতিক সম্পাদক করা হয় মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুবকে। তিনি সাহিত্য সাংস্কৃতিতে খুবই আগ্রহী ছিলেন। চমৎকার চমৎকার সব দেয়ালিকা বের করতেন তিনি। বিভিন্ন ব্যাপাারে তখন মতিউর রহমান মল্লিক তার সাথে কথাবার্তা বলতেন। যদিও মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন এবং এসব বুঝতেনও ভাল। তবু গানের দিকটা মতিউর রহমান মল্লিকই দেখতেন।
ইতিমধ্যেই আরো কয়েকজন শিল্পী পাওয়া গেল। এদের মধ্যে নুরুজ্জামান ফারুকী ছিলেন অন্যতম। এ সময় গান শেখা হয় বেশ কয়েকটি। তখন শিল্পীরা নিজেরা নিজেরাই বিভিন্ন গান শিখতেন। প্রচলিত নির্দোষ গান সাধারণত শেখা হতো। এরই মধ্যে সংগঠনের ভিতরে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কথা ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য নাম ছড়িয়ে পড়ে গোষ্ঠীর নাম অনুযায়ী নয়। বরং শিল্পীদের একটি গ্রুপ হয়ে উঠেছে এ হিসেবে। এরই ফলশ্রুতিতে একটি প্রোগ্রামের ডাক আসে সংগঠনের বাইরে থেকে। তখন ঢাকা জেলা সভাপতি শফিকুল্লাহ। তিনি প্রোগ্রাম নেন। প্রোগ্রামটি হলো ঢাকার মোড়াপাড়া কলেজে। কলেজের অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কলেজের অধ্যাপক মাহমুদ হোসাইন আল মামুনের মাধ্যমে এ অফার এসেছিল। প্রোগ্রাম নেয়া হলো। মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুবের নেতৃত্বে মতিউর রহমান মল্লিক, আবদুল হালিম, নূরুজ্জামান ফারুকী সহ কয়েকজন শিল্পী যান ঐ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে গান শুরু হলে ছাত্ররা ক্ষুব্ধু হয়ে উঠে এবং প্রতিবাদ জানাতে থাকে। ঐ অনুষ্ঠানে দারুনভাবে লজ্জিত হওয়ার কারণ ছিল যেহেতু শিল্পী গোষ্ঠী নাম দিয়ে গান গাওয়া হচ্ছে অথচ গানের সাথে বাদ্যযন্ত্রের কোন একটিও ব্যবহার করা হয়নি- এ জন্য। তাছাড়া ছাত্ররা যেহেতু যুগের সব ধরনের যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে গান শুনে অভ্যাস্ত সেখানে বাদ্যযন্ত্রহীন গান তো খারাপ লাগারই কথা। এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার। অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার আগে তাৎক্ষনিকভাবে গোষ্ঠীর নাম দেয়া হয় ‘ব্যতিক্রম শিল্পী গোষ্ঠী’। এ অনুষ্ঠানে দারুন লজ্জা পেলেও তাৎক্ষনিক ‘ব্যতিক্রমের’ শিল্পীরা হতাশ হননি। সেখানে থেকে এসেই সবাই ভাল প্রোগ্রাম উপহার দেয়ার জন্য নানাভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেন।
আগেই বলা হয়েছে তাদের গান প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য কোন অফিস ছিলনা। যার ফলে ইচ্ছা থাকা সত্বেও মনের মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। তাছাড়া সংগঠনের অফিসে গানের ক্লাশ হলে অন্যান্য প্রোগ্রামের ক্ষতি হবে। তাই তারা অন্যত্র গানের প্রশিক্ষণ নেয়ার চেষ্টায় থাকেন। একবার তারা একটি স্থানের সন্ধান পেলেন। মাওঃ আবদুল খালেকের এর মাধ্যমে সন্ধান পেয়েছিলেন ঐ স্থানটির। তিনি সেখানে থাকতেন। স্থানটি হলো বংশালের একটি রিক্সা গ্যারেজ মেস। স্থানটি তেমন উন্নত ছিল না।
পরবর্তীতে সেখানে গানের প্রশিক্ষণ চলতো। যখন গানের ক্লাশ চলতো তখন আবার সেখানে রান্নার আয়োজন করতো বাবুর্চী। ফলে সবটুকু স্থান ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত। এই ধোঁয়ার মধ্যেই চলতো গানের ক্লাশ। খুব কষ্ট করে গান শেখা হতো তখন। এভাবে তাদের গানের প্রশিক্ষণ ধীরে ধীরে এগোতে থাকে।
তখন গান শেখার পাশাপাশি যে কাজটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো শিল্পী সংগ্রহ করা। এজন্য এ গ্রুপটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিবস পালনে প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো। যেমন- ফররুখের জন্ম মৃত্যু দিবস, একুশে, সীরাতুন্নবী ও অন্যান্য দিবস। এসব দিবসে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকতো। হামদ না‘ত, আবৃত্তি, স্বরচিত কবিতা পাঠ ইত্যাদি বিষয় রাখা হতো। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু শিল্পী অবশ্য পাওয়া যায়। এদের মধ্যে আবুল কাশেম অন্যতম। তাকে পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিষদ মিলানায়তনের একটি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে। আবদুল করিম নামে আরো একজন শিল্পীকে পাওয়া গিয়েছিল। যিনি ভাল নজরুল সঙ্গীত গাইতে পারতেন। কিন্তু পরবর্তী সময় তাকে আর পাওয়া যায়নি।
শিল্পীদের একটি গ্রুপ তৈরী হওয়ার পর সংগঠনের সব দায়িত্বশীলই এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতেন । তখন এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের মধ্যে বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
এনামুল হক মঞ্জু যখন মহানগরী সেক্রেটারী ছিলেন তখন তিনি বেশ খোঁজ খবর নিতেন। এটিএম আজহারুল ইসলাম যখন মহানগরীতে আসেন তখন থেকেই শিল্পী গোষ্ঠী নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে এবং তার সময়েই একটি সদস্য বৈঠকে শিল্পী গোষ্ঠী গঠনের প্রস্তাব আসে নাম সহ। ‘সাইমুম’ নামটি তখন প্রস্তাবে আসে। ঐ বৈঠকে এ নামের প্রস্তাবক ছিলেন মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব । প্রস্তাব দেয়ার পর এটা নিয়ে আলোচনা হয় এবং পরে ‘সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী’ নামে তা গৃহীত হয়। সালটি ছিল ১৯৭৮ সাল।
...
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন